বিম্বিত বিস্ময়

বাবা (জুন ২০১২)

মামুন ম. আজিজ
  • ৩৩
  • ৫৮
এক.
উচ্চ-প্রযুক্তির আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন একটা স্পষ্ট নয় তবে প্রকৃতির অনাবিল-অকৃত্রিম রূপ নৈসর্গিক মাধুর্য জাগিয়ে হাস্যেজ্বল নান্দনিকতা ছড়িয়েছে চারপাশে। নতুন আসা কোন পথচারীকে মাত্রা ছাড়ানো মুগ্ধতায় বিমোহিত হতেই হবে। যদিও আধুনিক সভ্যতায় গতির ঘর্ষনে উত্তপ্ত রক্তের মানুষগুলোর এমন নির্ভৃত এক গ্রামে বিনা কারনে পদচারণার কোন কারনই থাকতে পারেনা। বাস্তবতা তেমনই। তবে হতে পারত এটা কোন অনাবিল অবসরকেন্দ্র, হতে পারত পর্যটনের সাজানো বাগান, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাসের নিবিড় কর্মপন্থা পর্যালোয়নায় এ দেশে সেটা যে সম্ভব নয় তা স্বল্প শিক্ষিত মাত্রই বোঝে। এ দেশে পরিকল্পনা অনেক কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই স্বল্প। কক্সবাজারের মত এত বড় উপকূল তীর ..সেটাই বিশ্ব মানের পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠলোনা এতগুলো বছরেও আর হবে এই ক্ষুদ্র সবুজের নির্ভৃত গ্রাম - সুবর্ণধাম!

সুনিবিড় এই সুবর্ণধাম গ্রামের সবুজ সৌন্দর্য বিচ্ছিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বাংলার আর শত গ্রামের মতই এখানে দুষ্টু চত্র আছে, সে চক্রে মেম্বার আছে, উঠতি নেতা আছে, ক্ষমতার দুষন যুক্ত ব্যকিং পাওয়া নষ্ট যুবক আছে, প্রবীণ কুচক্রি আছে, আর আছে একদল খেটে খাওয়া মানুষ।

তিনপাশ নদীতে ঘেরা। একপাশে সুবর্ণ নদী। স্বচ্ছ জল, কুল কুল স্রোতের ধারা-এখনও সভ্যতার পায়ু নিঃসৃত কালো মল বুড়িগঙ্গার মত কোন কালো রঙ সেখানে ঢালতে পারেনি। নদীর দুকূল জুড়ে উচুঁ কাশবন। একটু অদূরেই এক বিশাল বট গাছ। বহু প্রাচীন। মুখে মুখে যুগে যুগে চলে আসছে গাছটি নিয়ে নানা পৌরাণিক উপকথা। বটগাছের ছায়াতল মাড়ালে অনেকখানি এলাকা জুড়ে ফলের বাগান। বাগানের পরেই মূলত গ্রামের মূল হাট। সেখান দিয়ে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভেতর। একটাই মাত্র পাকা রাস্তা। দুধারে বিল, বিলের মাঝে মাঝে মাঝে উঁচু কিছু টিলা চোখে পড়ে, কৃষকগণ টিলার উপর বিশ্রাম নেয় ভর দুপুরে। রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে একদিকে বড় নদীর পাড়ে উঁচু বাধর সাথে। বাধের উপরে নানান গাছ বড় হতে হতে কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। পাকা রাস্তার অন্য পাশ পৌরাণিক বটগাছ এড়িয়ে সুবর্ণ নদী পার হয়ে গঞ্জে গিয়ে উঠেছে। সুবর্ণ নদীতে কবে কোন এমপি একটা অর্ধবৃত্তাকরা উঁচু ঢেউ খেলানো ব্রীজ নির্মাণ করেছিল, বেশ লাগে দূর থেকে দেখতে। যদিও রিকশা ভ্যান ছাড়া তার উপর দিয়ে কিছূ পার করানো সম্ভব নয়।

গ্রামের ঠিক মাঝখানে খানিকটা উঁচু জায়গা আছে। সেখানে পুরাতন কালের কিছূ পাকা ইটের দেয়াল এখনও টিকে আছে। সম্ভবত সেখানে কোন এককালে বৌদ্ধ মঠ ছিল। সুবর্ণধাম নামটিও শোনা যায় সেই আমলেই রাখা। ওটার পেছনেই কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে তারপর একটা বড় বাঁশবাগান। বাঁশবাগানের সাথে লাগোয়া ছোট দুটো খড়ের ছাউনি ঘর, সামনে এক চিলতে উঠোন। ডানপাশে ক্ষেতি করার মত অল্প কিছূটা জমি। সেখানে বাস করে দুুটি মাত্র প্রাণী - গঙ্গল দাস আর তার মেয়ে গৌরি।

গঙ্গলের বউটা মারা গেছে গৌরির দু’বছর বয়েসের সময়। তার পর আর বিয়ে করেনি সে। হাতে গোণা দশ বারোটা হিন্দু পরিবারের বাস এখানে এই গ্রামে এখন। আর সকলে সেই কবেই একাত্তুরে ওপারে পালিয়েছে। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে সুভাকাঙ্খিরা অনেকেই কলকাতায় চলে যেতে বলেছিল। সেখানে গঙ্গলের দু’ভাই আর দু’বোন থাকে। মোটামুটি ভালো অবস্থা সবার। কিন্তু সে গেলোনা। গঙ্গলের বাবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেহত্যাগ করেছিলেন। কোথায় যেন একটা মায়া। হয়তো মিছে-হোক না, মায়াতো মায়াই। তার উপর তাদের এই এত সুন্দর গ্রাম, মন ছাড়তে চায়না। জিদ চেপেছিল মেয়েটাকে বড় করবে, যত কষ্টই হোক তাকে সে লেখাপড়া করাবেই।


দুই.
নদী পেরিয়ে অনেখানি খোলা প্রান্তর। এখানেও কয়েকটা ছোট বট গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিযে। আর একপাশে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে সমতল। ঘড়বাড়ি শুরু হয়েছে আরও কিছু দূরে। এই পথে প্রায় কিলোমিটার খানেক হাটলে গঞ্জের অনেকখানি আগেই হাতের বামে হাই স্কুলটা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। গৌড়ি সেখানে ক্লাশ সেভেনে পড়ে। সকালে ভ্যানটা নিয়ে খেপ মারার জন্য গঙ্গল গঞ্জের দিকে যাবার সময় মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়। ফেরার সময় অবশ্য মেয়েকে একাই ফিরতে হয়। এই নিয়ে শুরু হয়েছে আজকাল গঙ্গলের নতুন দুশ্চিন্তা। আগে যখন গ্রামের ভেতর হাটের কাছে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত তখন এত টেনশন ছিলনা। পাশের বাড়ীর কাকীমার সাথে গৌড়ির স্কুল ফেরত বাকী সময় ভালোই কেটে যেত। কিন্তু সে আর কতদিন! এই তো কয়েকদিনর আগেই পাশের বাড়ির বৌদিকে গঙ্গল বলছিল ‘বৌদি, ভগবান এত সুন্দর মাইয়া দিছে, মনে হয় হারাদিন তাকাই থাকি, চোখের আড়াল করবার মন চায়নাগো একরত্তিও। আজকাল ভয় কুইরা কুইরা খাইয়া ফেলায়, যে দিনকাল, কেমনে মাইডারে বাঁচাই, ছেলে ছোকড়া সব পিছে লাইগ্যা রইছে..’

‘আরে গঙ্গল, গরীবের মাইয়্যা সুন্দর হৈছে তো ভালা কথা, তোর টাকা-পয়সা খরচ হৈবনা, তোর মাইয়্যারে বিয়া দিয়া দে, ঢাকায় আমার এক বোইনের পোলা আছে, হের ঢাকায় চুল কাটার দোকান আছে, নিজের দোকান, তুই চাইল্যে হের লগে..’

‘এইডা কি কও বৌদি; গৌরি বাচ্চা মাইয়্যা, হেরে আমি পড়ামু, বড় করমু, নিজের পায়ে দাঁড়া করামু।’

‘হ, তোর লাইগ্যা তো তদ্দিন কাক শকুনেরা বইয়্যা থাকব। হারাদিন তো থাকছ কামে, মাইড্যার মা নাই, যতই মার লাহান লালন করছ না কেন, তুই মা তো আর হইতে পারবিনা। বিয়াও করলিনা আর। রাস্তা দিয়া যখন গৌরি স্কুলতে ফেরে, খোঁজ রাখছ পোলাপান পেছন থেকে আজে বাজে কথা কয়, তার উপর আমরা হৈছি সংখ্যা লুঘু। ’

‘কেডায়, কেডায় আমার এট্টুকুন বাচ্চা মাইযাডারে আজেবাজে কথা কয়, কেডায়। একবার নাম কওদিহি, এক্কেরে ধান কাটনের কাচিডা দিয়া হের কল্লা নামাই দিমু না।’

‘হ তুই আমার বালডা ফালাবি। সব পাতিপুতি নেতা হৈছে আইজকাল। এমপি আইলে হেইসব পোলাপানরে খাতির করে, হারাদিন মেম্বারের চামচামি করে। তোর লাহান ভ্যান চালক তাও হিন্দু ব্যাটারে হেরা বাল দিয়াও পোছেনা। তোর দাদার কাছ থেকে হেইদিন হাটে পাঁচশ টাকা রাইখা দিল, হেগোর কি সিন্নির চাঁদা বলে। কি কলি যুগ যে আইল।’

‘দাদায় দিছে কেন, কোন আইন নাই নাহি। তোমার পোলা গঞ্জে সরকারী অফিসের ক্লার্ক, হেয় কি করে, মেম্বারওে কও নাই?’

‘আইন, হেইডা আবার কি রে? আছে নি আজকাল? অত বাড়িস না, একে সুন্দরী মাইয়্যা, গায়েগতরে তো ডাগর হৈছে হেই কবেই। হৈছোস তো বাপ, হেইসব জানবি কেমনে , মাইয়্যার যে মাসিক হয় , হেইডাও কি খবর রাখস? শোন তোর মাইয়্যারে কাল থেইক্যা আর স্কুলে পাঠান লাগবোনা। সেই কোন খানে স্কুলডা। পথে কত পোলাপানের শকুন নখ ছিঁড়া খাইবো, টের পাবি! তোরে তো মনে হয় কিছু কয়নাই গৌরি?’

‘কি বৌদি, কি কয়নাই?

‘হের স্কুলে এক পোলা মাষ্টার আছে, হেয় বলে তোর মাইয়্যার বুকে হাত দিবার চায় বারবার।’

‘এই ডা কি কও বৌদি, গৌরি কইছে তোমারে? আমারে যে কিছু কইলোনা..?’

‘তুই না বাপ, তোরে কি সব কওন যায়। তুই ভাইবা দেখ। ঢাকায় গিয়া ভালোই থাকব। ’

সে ভাবনা মাথায় তখন কাজ করছিলনা গঙ্গলের , তবে চলে আসতে আসতে ভাবছিল, এত যত্ন কইরাও মেয়ের কি তবে মা সে হতে পারলনা। বাবা আর মা তবে কি সত্যিই অনেক তফাৎ। পরক্ষণেই আরও গভীরে ভাবনা ঢুকে অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয় তার। গঞ্জে থাকে সারাবেলা, পেপার পত্রিকায় ভালোই চোখ বুলায়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ছোটবেলা পড়ছিল গঙ্গল। তারপর আর পড়া হয়নি। বাপের লগে ক্ষেতেই কাজ করত তখন। অনেক জমিজমা ছিল। তার ছোট দুইভাইকে ওপারে পড়তে পাঠিয়েছিল। বাবা আর সে মিলে কাজ করত জমিতে, গঞ্জে একটা দোকানও ছিল বাবার। সব গেছে, ভাইরা ফিরেছিল। কিন্তু ভাইরাও পালাল এক সময়, জমি জমা দোকান সব গেলো ঐ যুদ্ধে। সে তো অনেক আগের কথা। একমাত্র যক্ষের ধন গৌরিকে নিয়ে তো সে ভালোই ছিল এতকাল। এত লক্ষ্মী আর এত সুন্দরী তার মেয়ে। কি মিষ্টি মুখ, ঠিক তার মার মত। তবে গায়ের রঙটা দুধে আলতা, এটা পেয়েছে তার নানীর কাছ থেকে। সুবর্ণধামের সুর্বণ কন্যা গৌরি। সবাই তাকে ছোট থেকে কত আদর করে। ঐ তো মেম্বারের বাড়ীর লোকজনওতো কত খাতির করে। ঢাকা থেকে মেম্বারের মেয়ে-জামাই,নাতিরা আসলে গৌরির ডাক পড়ে। তাদের সাথে থাকে। ঘুরে ফিরে গ্রাম দেখায়। কত কিছু দেয় তারা। কত আনন্দের মেয়ে বাবার সংসার। দারিদ্রতা আছে, কিন্তু অশান্তি নেই। গত পূজার সময় মেয়েকে নিয়ে গঞ্জে মেলায় ঘুরতে গিয়েছিল, মেয়ে বাবার কোলে উঠেছিল হাঁটতে হাঁটতে যখন পা ব্যাথা হয়েছিল। সেই মেয়ে এত বড় কখন হলো সে ভেবে পায়না।

আসলেই কি বড় হয়েছে। নাকি নরচোখ তাকে বড় করে তুলছে! গঞ্জে পত্রিকায় ঢাকার এক নামকরা স্কুলের এক অধম শিক্ষকের ছাত্রীর সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের খবরাকবর সে পত্রিকায় পড়েছিল। গঞ্জে এই নিয়ে আলোচনাও শুনেছিল। নির্ভৃত গ্রাম, কিন্তু সভ্যতার নষ্ট খবর আসার পথতো এ যুগে আর কমনা। গঙ্গল ভাবে, এই গ্রামের স্কুলেও শিক্ষকও কি তবে তেমনই ..ছিঃ ছিঃ। অনৈতিক খবর মানুষকে সাবধান করবে তা না বরং আরেক লম্পট মাষ্টারকে অনুপ্রেরাণিতও করে তুলেছে।

ঘরে এসে সেদিন মেয়েকে জিজ্ঞাস করতে গিয়ে লজ্জিত একটা ভাব তার চেহারায় কাজ করে। তবুও জিজ্ঞেস না করে পারেনা। মেয়ে লজ্জাবনত বদনে মাথা নাড়ে। সাথে মেয়ে যোগ করে আরও নতুন কিছূ তথ্য- মেম্বারের ছোট ভাইয়ের ছেলে জগলু সেদিন বট গাছ তলায় আড্ড দিচ্ছিল। স্কুল থেকে ফিরছিল গৌড়ি আর তার আরেক সখি । মন্তেজ নামের একটা চামচা দৌড়ে আসে তাদের দিকে। গৌড়িকে বলে- জগলু ভাই ডেকেছে । বট গাছে ছায়ায় গৌড়ির কেঁপে ওঠা ছায়া ঢেকে গিয়েছিল। জগলুকে সে চেনে। জগলুও তো চেনে ভালোই, তবুও জিজ্ঞস করে, ‘তুই গঙ্গল ডাইভারডার মাইয়্যা না? হ্ইাস্কুলে উঠসছ। বা বেশ। আমাগো লগে বন্ধুত্ব করবি? তোর মোবাইল আছে? দূর ঐ ফকীর মালায়নের ঘরে জন্মাইছস, মোবাইল পাবি কই। আমি দিমুনে, এখন যা। শোন, তোর কিন্তু ঐ ডা আসল বাপ না, হে তরে কুরাইড় আনছিল, তুই কইলাম আসলে চারাল না।’

গৌরির গলা কাঁপে, বুকের উপরে উঁচু হয়ে থাকা অংশে স্কুলের ওড়নাটা টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলে ,‘এইডা জগলু ভাই আপনে কি কন?’

‘আরে ঠিকই কয় ওস্তাদ, তুই আবার ওড়না সরাস কেন, আমরা কি পর রে।’

‘আমি যাই জগলু ভাই, কাকীমা বকবো দেরী হৈলে।’

‘যা যা, তয় কাল আবার আইস যাওনের সময়...’

এইবার সত্যি সত্যি ভয় নামক বিষয় নির্ভীক গঙ্গলের মাঝেও ঢুকে পড়ে ঠিক যেমনি থিকথিকে কাদার মধ্যে ঢুকে পড়ে মুহূর্তে পিচ্ছিল শিং মাছ।


তিন.
তিনদিন হলো গৌড়ি স্কুলে যায়না।

গঙ্গলের মধ্যে ভয় ঢুকে পড়ার পরদিন গঙ্গল নিজে তাকে স্কুলে দিয়ে এসেছিল। আবার ছুটির পরে গঞ্জের মাল টানার কাজ ফেলে মেয়েকে স্কুল থেকে নিতে চলেও এসেছিল। মেয়ের সাথে গতরাত্রে বাবার সাথে মা সুলভ একটা পুরাতন সম্পর্কে নতুন করে কুড়ি জন্মেছে। সেই সূত্রে অকপটে জানায় সেই শিক্ষক তাকে আজও রুমে ডেকেছিল , কথায় কথায় তার হাত ধরেছিল, হাতটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল, গৌরি দৌড়ে বের হয়ে আসে, তারপর বাবার কথা মত স্কুলের এক আপাকেও ঘটনাটা জানায় সে। সেই আপার সাথেও গঙ্গল দেখা করেছে আজ। আপা বলেছেন, ‘এমপির জোড়ে ঐ শিক্ষক চাকরী পেয়েছে, নতুন শিক্ষীকাদের সাথেও সে ভাল আচরণ করেনা কিন্তু তার বিরুদ্ধে যেতে হলে বিষয়টা এত সহজ তো নয়। প্রমাণ করা কঠিন হবে।’ গৌড়িকে দূরে দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন তিনি।

মেয়েকে নিয়ে সুবর্ণধামের দিকে ফিরতে ফিরতে এই নিয়ে যখন ভাবছিল, তখন চোখ গেলো বট গাছের তলায় জগলুর আড্ডায়। তারাও তাকিয়েছিল। দূর থেকেই গঙ্গল স্পষ্ট শুনতে পেলো, মন্তেজ ছেলেটা বলছে, ‘ একদিন তো একা যাবিই রে.. সেদিন।’

এবার আর ভয় ঢুকলোনা। ভয় গর্তে স্থায়ী আসন গেড়ে নিল। মেম্বারকে জানানোর কথা ভাবল। কিন্তু এখানেও যদি প্রমাণের অভাব হয়। গঞ্জে পত্রপত্রিকা পড়ে আর ডিশের চ্যানেলের চায়ের দোকানে খবর শুনতে শুনতে এটা সে বোঝে যে প্রমাণ করা এই পোড়া দেশে বেশ কঠিন।

ক’দিন তাই কাকীমার সাথে কাকীর ঘরের কাজে টুকটাক সহযোগীতা করাই গৌরির প্রধান কাজ।

গঙ্গল নিজে স্কুলে নিয়ে যাবে সে উপায়ও ক’দিন ধরে নেই। সুবর্ণধামের সুবর্ণ সৌন্দর্যের খবর পৌঁছে গেছে বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রাকায়াত আফসার টনির কাছে। তিনি একাধারে অনেক কিছু। পুরো দেশের সকলেই, তা সে গ্রাম গঞ্জই হোক না কেনো, তার নামটা জানে। একটা বড় অ্যডফার্মের কর্ণধার তিনি। বেশ কয়েকটা সফল বানিজ্যকি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। টিভি মঞ্চে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। অনেকগুলো নাটকও বানিয়েছেন। বেশ শখ করে একটা টেলিফিল্ম বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন। অনেক দিন ধরে মনোরম একটা গ্রম্যা লোকেশন খুঁজছিলেন। সুবর্ণধামের খবর কানে আসতেই একবার এসে দেখেই মুগ্ধ হয়েছেন। দেখার একমাস বাদেই এসে পড়েছেন শুটিং করতে। মেম্বার সাহেব তার বাড়ীতে থাকার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু রাকায়তাত সাহেব রাজী হননি। এত সুন্দর নদীর কিনার, পৌরাণিক বট গাছ-সব তাকে ভীষন টেনেছে। তিনি সেখানেই থাকতে চান। তার একটা বড় লরি টাইপ গাড়ী আছে। সেটার ভেতরটা কোন সুদর্শন বেডরুমের চেয়ে কমনা। গাড়ীটা নদী পার করানোও যাবেনা। বটগাছের তলায় থাকা হলোনা, তবে ওপারে ফাঁকা পরিসরে নদীর কূল ঘেঁষে একটান ছোট বট গাছের ছায়ায় নিরিবিলিতে গাড়ীটি রাখা হয়েছে। আর বাকী শুটিং টীম কাছেই টাবু টানিয়ে থাকছে। দিন বিশেক হয়তো লাগবে শুটিংয়ের জন্য। টেলিফিল্মের প্রায় ৯০ শতাংশ এখানেই শুটিং করবেন বলে ভেবে নিয়েছেন রাকায়াত। ছবিতে মুখ্য নারী চরিত্রে রেখেছেন হালের সবচেয়ে হিট নায়িকা ঈপ্সিতাকে। সবচেয়ে সফল বানিজ্যিক নায়িকা এই মুহূর্তে সে তারপরও রাকায়াতের এই স্বপ্নের টেলিফিল্মেও প্রস্তাব সে ডিনাই করেনি। রাকায়াতই তো তাকে টপ মডেল বানিয়েছিল। সেটাই তার প্রাথমিক সিঁড়ি। সে কি করে ভোলে! সব শিডিউল বিশ দিন পিছিয়ে সে ছুটে এসেছে রাকায়াত ভাইয়ের এক ডাকে এই নির্ভৃত সুবর্ণধামে।

শুটিং ইউনিট দুটো ভ্যানগাড়ী চেয়েছিল মেম্বারের কাছে, শুটিং দলে গঙ্গলের সেই সুবাদে যোগ দিতেই হলো। অবশ্য আয় খারাপ হচ্ছেনা। পরিশ্রম আছে। সরারদিনই কেউ না কেউ ভ্যানে গঞ্জে যাচ্ছে। এটা আনছে ওটা আনছে। ঢাকা থেকে নায়িকার জন্য খাবারও এসেছে কয়েকবার, সেটাও গঞ্জ থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে গঙ্গলকেই। শুটিং উইনিটে এখন তার বেশ গরজ। এর ওর মুখে যেন লেগেই রযেছে-এই গঙ্গল এটা কোথায় পাব, ওটা কোথায় পাব, ওখানে কি আছে-এইসব।

রাকায়াত টনির মত বিখ্যাত মানুষের আগমন এই ধরাধামে। গ্রামের লোকতো মহা খুশি। তাদের এই অপরূপ রূপের গ্রামের কথা শহরের মানুষের দৃষ্টিতে আকর্ষন ঘটাতে শুরু করেছে। নিরাপত্তা নিয়ে একটু সমস্যা ছিল। এমপির সাথের রাকায়াত এর পরিচয় আছে। এমপিও মেম্বারকে একবার ফোন দিতেই সব আরও একটু বেশিবেশি আয়োজিত হতে লাগল। মেম্বার সাহেব তার পুরো বাহিনীকে স্থায়ী আড্ডায় বসিয়ে দিয়েছে শুটিং স্পট ঘিরে। জগলু সেই দলের লিডার। ইদানিং এমপির কাছেও জগলুর বেশ কদর। মেম্বারের ছেলেরা কেউ রাজনীতিতে আসেনি। ভাইয়ের ছেলে এসেছে। এমপি তার মাঝেই নতুন মেম্বার খুঁজে পাচ্ছেন, যোগ্য যুগের যোগ্য দস্যি মেম্বার। যদিও পুরাতন মেম্বার সাহের জগলুকে তেমন একটা পছন্দ করেনা। কিন্তু এমপি তার চেয়ে জগলুকেই আজকাল বেশি তোয়াজ করছে। পছন্দ না করে কি উপায়!

জগরু আর তার শিষ্যগুলোকে রাকায়াত যথেষ্ট খুশি করে রেখেছে। সে মানব চরিত্র জানে । রাতে ঢাকা থেকে আনা বিদেশি বোতল তো রয়েছেই। এমনকি দ্বিতীয় রাতেই একটা নাচের শুটিংয়ের জন্য এক্সটা আনা হয়েছিল । এক রাত ছিল সেই ট্রুপের মেয়ে কয়টা। এমনতে টাকা ছাড়া তারা দেহ দান করেনা। কিন্তু রাকায়াত সাহেবের কথায় জগলুরা সে দেহের স্বাদ বিনে পয়সাতেই পেয়ে গেলো।


চার.
গঙ্গল অনেক কিছু জানলেও এত কিছু তার জানার কথা না। সন্ধ্যার পর পরই সে চলে যায়। ঘরে মেয়ে একা থাকে।

শুটিয়ের পঞ্চম দিন।

গৌরি শুটিং দেখতে চাচ্ছিল। গঙ্গল না নিয়ে পারেনি। এত লোক সেখানে। জগলুরা আর কি করবে। মনে মনে তার আরও একটা গোপন অভিলাষ যেন হঠাৎ নাড়া দিয়ে উঠতে না চাইলেও উঠল- এত মিষ্টি মুখ তার মেয়েটার যদি পরিচালক সাহেবের পছন্দ হয়। মেয়েটাকে কোন চরিত্রে নিয়ে তবে নেয় কেমন হয়। তারপর আবার ভাবে, দূর এ লাইন শুনেছে ভালোনা।

শুটিং চলছিল। সবাই খুব ব্যস্ত। গৌড়ি বাবার ভ্যানের উপর বসে শুটিং দেখছিল আর খুব মজা পাচ্ছিল। স্পটের একটু ওপাশে আড্ডা দিচ্ছিল জগলুর গ্রুপ। কয়েকবারই জগলুর সাথে চোখাচুখি হলো। চারদিকে কোথায় গঙ্গলকে চোখে পড়ছেনা। সেই সুযোগে জগলু মন্তেজকে পাঠিয়েও দিল গৌড়িক ডেকে আনার জন্য।

ইতিমধ্যে রাকায়াত সাহ্বেও একটা শট নিয়ে যেই চেয়াটাতে বসে কপালের ঘামটা মোছার জন্য তার এসিসটেনন্ট মেয়েটার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়েছে ওমনি চোখ গেলো গৌরির দিকে। মুহূর্তে তার মনের নারীলোলুপ অংশটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। দ্রুত খবর নিল-মেয়েটা কে? জানা মাত্রই গঙ্গলকে ডাকা হলো।

গঙ্গল যেন সকালের সূর্যকে নতুন করে আবার উঠতে দেখল। লেখাপড়া যদি নাই হয়, অন্য ভাবেও মেয়েটাতো বড় হতে পারে। নাম করেত পারে। এত রূপ নিয়ে তার মাঝে কি নায়িকা হবার কোন কমতি আছে।

রাকায়াতের অফার সে লুফে নিতে চাইল। বলল, ‘ও কি অভিনয় করবার পারব সাব? ওতো শুদ্ধ করে কথা বলবারই পারেনা।’

রাকায়াত বলল, ‘ আমার উপর ভরসা আছে তো তোমার, নাকি? ওকে আমার সাথে এই ক’দিন এখানে রাখো । আমার চোখ ধোকা খায়নি কোনদিন। তোমার মেয়ের জন্মই হয়েছে অভিনয় করার জন্য। এই ছবিতে একটা ছোট রোল দেব, এরপর পরবতীতে আরও শিখিয়ে কোন ছবিতে নায়িকা বানাবোই।’

রাকায়াত তার স্বপ্নের এই টেলি ফিল্মে এমন মিষ্টি এক মেয়ের জন্য আরেকটি স্বপ্নের চরিত্র সংযোজন করবে এমনটাই মনে মনে ভেবে নিল। এ তার জন্য কোন বিষয় না। এ মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন অভিনয় দরাকর নেই এর মুখের দিকে তাকিয়েই মুগ্ধ বিস্মিত হবে কোটি দর্শক। একে কি দূরে রাখা যায়। কত কত মডেল নায়িকার দেহ স্পর্শ করে আজ তবে সিদ্ধ পুরুষ হয়েছে সে, তবুও এই কচি তন^ী গ্রাম্য বালিকার কি একটা সরলতা তাকে টানছে। একে তার আপন করে নিতেই হবে।

রাকায়াতের বড় হোম সাইজ লরিটার মধ্যে দুটো রুম । একটাতে নায়িকা ঈপ্সিতা থাকে। তার সাথেই সর্বক্ষণ গৌরির থাকার ব্যবস্থা করে দিল রাকায়াত।

এত বড় ব্যক্তি তার মেয়েকে পছন্দ করেছেন, তাকে তার সিনেমায় নিচ্ছেন। তার উপর যে নায়িকার মুখটা দেখতে হাটের টিভির সামনে কত ঠেলাঠেলি পড়ে যায়, গঞ্জের সিনেমা হলে টিকেট পাওয়া যায়না, সেই ঈপ্সিতা ম্যাডামের সাথে একসাথে তার মেয়ে থাকবে- একি ভাবাই যায়! আনন্দে দুচোখ বেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু নেমে এল গঙ্গলের। মেয়েকে কাছে ডেকে বললেন, ‘ভুল কইরাও কারও কোন কথার অবাধ্য হইবিনা, কোনরম বিরক্ত করবিনা, স্যার মেডাম যা বলেন হুনবি।’


এমনি করে দুইদিন দুইরাত কাটিয়ে দিল গৌরি শুটিং টীমের সাথে। রাতে ঈপ্সিতার ঘরে সরু মেঝেতে থাকে। সারাদিন শুটিং উইনিটে ঈপ্সিতা ম্যাডামের টুকটাক ফাইফরমাস খেটে দেয়। এর মধ্যে একটা ছোট অডিশনও নিয়ে নিয়েছেন রাকায়াত সাহেব তার। সেখানেই রাকায়াত সাহেবের মন আরও উতলা হয়েছে। ঈপ্সিতাকে বলেছে আরেকটু মিখিয়ে পরিয়ে নিতে। শকুন চোখ রাকায়াত সাহেবের। গৌরির আশেপাশে জগলু আর তার সাগরেদদের আনাগোনার বারংবার চেষ্টাও তার চোখ এড়ায়নি। কিছূ বললেন না। তবে একটা ক্রুর হাসি ঠিকই তার ঠোঁটে ঝিলিক দিয়েছিল। পাকা খেলোয়াড় ছিলেন; এখন কোচ, কোন খেলোয়াড়কে কখন খেলাতে হবে তিনি ভালই জানেন। ঈপ্সিতা অবশ্য এক ফাঁকে রাকায়াতকে নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে বলছিল, ‘মেয়েটা অনেক ইনোসেন্ট, খুব ছোট-তোমার কোন বদ মতলব থাকলে ...’

রাকায়াত সে কথা শেষে না করতে দিয়ে বলে উঠল,‘দূর ডালিং , তুমি থাকতে আর কেউ লাগে, আমি জাত চিনি, ও মেয়ে সোনার ডিম দেবে, দেখে নিও।’

পাঁচ.
সকালে শুটিং অনেকটা সময় বন্ধ ছিল, বৃষ্টি হয়েছিল রাতে। নায়িকার একটা বৃষ্টি ভেজো গান শুট করা হলো। তারপর বৃষ্টির মাঝে যে যার মত চলে গেলো বিশ্রামে। অপূর্ব নদীর কূলে, পৌরাণিক ঐ বট গাছের তলে দৃশ্যাবলী সকলকে মুগ্ধ করেছিল আরেকটু বেশি মাত্রায়। মানব মানবীর মনে প্রেমের ডঙ্কা বাজার সুর লেগেছিল পালে। জগলুও খুব গৌরির কাছে যাওয়ার সাধ হচ্ছিল। কিন্তু রাকায়াত সাহেবকে সে খুব শ্রদ্ধ করতে শুরু করেছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছিলনা।

পরদিন সকালে কাদাপানি ঢাকার কাজে একদল ব্যস্ত। গ্রাম থেকে কিছু লোককে লেবার হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। এই ফাঁকে গঙ্গল গৌরিকে বৌদির ওখানে রেখে আসে। পুরো সকালটা ওখানেই কাটে তার। কাকীমাকে ক’দিনের শুটিংয়ের গল্প করতে করতে হাপিয়ে ওঠে গৌরি। এই দুদিনে সে কত জ্ঞানী হয়ে উঠেছে , অবাক হয় তা কথার ঢংয়েও পরিবর্তন দেখে কাকীমা।

দুপুরের পর থেকে শুটিং চলে যথারীতি। বাঁেধর ওদিকেও আজ কিছূ শুটিং হয়েছে। পুরো গ্রামটাই এত সুন্দর, চারদিক রাকায়াত কভার করবেই।

শুটিং টীমের লোকজন ক্লান্ত ভীষন। সন্ধ্যার পর ৮টার মধ্যে যে যার ঘরে বিশ্রামে ঢলে পড়েছে। গঙ্গল সব মালামাল নামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খেয়ে রাকায়াতের লরি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যায়। আর আর কোন উপদেশ দেয়ার প্রয়োজন হয়না। মেয়ে যেন অনেক শিখে গেছে কয়েকদিনেই। বাবার সাথে কথাও কম বলছে। সে যেন সভ্য হচ্ছে। বাবার মনে আনন্দ ঝর্ণা বইছেতো বইছেই।

এদিকে আকাশের অবস্থা আজকেও ভালোনা তেমন একটা। মেঘ করেছে। হালকা বাতাসও বইছে। ঝর হতে পারে। প্রতিটা ঝড় কত ভয়াবহ-ভাবতে ভাবতে গ্রামের দিকে এগোয় ভ্যান চালাতে চালাতে গঙ্গল।

মেয়ে নাই বাড়ীতে। বাড়ীটা পুরো খাঁ খাঁ করে। একরত্তিও ভালো লাগেনা গঙ্গলের। ১০টার দিকে উঠে বৌদির ওখানে যায়। কয়েকদিন ধরে ওখানেই রাতের খাবার খায় গঙ্গল। দাদা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বারান্দায় খেতে বসেছে । পাশে মায়ের মত বৌদি। গঙ্গলের মাত্র ১০ বছর বয়স- তখন এই বৌদির বিয়ে হয়। এ গ্রামে আসে। পাশপাশি বাড়ী। মায়ের মতই দেখে এসেছে। বৌদিও সব কথা না মানলেও তাই শোনে অন্তত। আজ বৌদি একটু বেশি যেন আব্দার নিয়ে কথা বলছেন, ‘মাইয়্যাডারে শেষ পর্যন্ত ঐ খানকি জগতে দিয়া আইলি? কইলাম বিয়া দে, তা না, তুই জানস না ঐসব সিনেমার লোকজন কত হারামী এগোর কোন জাত পাতআছে, বিয়া শাদী আছে, আজকে হের লগে,তো কালকে এর লগে। মন চাইলেই শুইয়া পড়তাছে বিছানায়। তুই জানসনা।’

‘বৌদি, সব লোক কি সমান। রাকায়াত সাব কত বড় মনের মানুষ। তুমি হেরে না দেখলে বুঝবানা। ’

‘হ দেখছি, টিভিতে কত দেখছিনা। ও আমার চেনা আছে। তুই জানস গৌরি কি কইতাছিল- তোর মাইয়্যাতো একদিনেই পাইক্যা যাইব।’

‘কি কইতাছিল হেয় আবার?’

‘ঐ যে তোর রাকায়াত আর ঈপ্সিতা লটর পটর করে রাইতে, হেইসব তো গৌরি দেখে...’

‘লটর পটর করবো কেন, এ নাইকাতো হের বউ না, হের বউতো হেইদিন আইছিল সকালে, আবার চইলাও গেলো।’

‘আরে ভোদাই, হেগোর কামই তো এইটা, যখন যারে তখন তারে.. তোর মাইয়্যাতো এত বোঝেনা, আমি তো হাসতে হাসতে শেষ,হেয় কয়- জানো কাকী ঐ সাব আর ঐ নায়িকা ম্যাম, হেরানা বিয়া করছে গোপনে, কেউ জানে না আমি জানি, রাইতে দুইজন একলগে শোয়। দুইজন এক লগে মদ খায়। আমি সেই সুযোগে ঈপ্সিতা মেডামের খাটে ঘুমাই। কি নরম বিছানা।’

‘কি কও এইসব, হাছা নাকি, মাইয়্যারে কি তবে পঁচা জলে ভাসাই আইলাম, আমার তো কিছু ভালা লাগতাছেনা। হেরে কি এখনই লইআ আইমু, কি কও। পুরা দুনিয়াই কি পঁইচা গেলো?’

‘সকালেই যা।’

‘না, মনডা টানতাছে না। যাই লইয়াই আসি। এইসব নষ্টামি হেরা বুঝুক, আমার মাইয়া আমারই থাউক।’

যেকোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে। তবুও ভ্যানটা বের করে গঙ্গল রওয়ানা দেয়। তার মনে আকাশের ঘনকালো মেঘের মত বাষ্প ঘন হয়েছে। বৃষ্টি না ঝরার আগ পর্যন্ত মন সাদা হবে না আর।

ছয়.
ঝিরিঝিরি বাতাস এসে মুখে লাগছে বারবার। অদ্ভুত শিহরণ। এই গ্রামটাই অদ্ভুত। এই গ্রামের গৌরিও আরও অদ্ভুত। মনের মধ্যে কে যেন শেষ বাক্যটা বলে গেলো।
হাতে বিদেশি ভদকার গ্লাস। পাঁচ পেগ সে ইতিমধ্যে গলধ:করণ করেছে । এই পরিমাণেই সে কুপোকাত হয়, তবে আজকে পরিবেশ ডিমান্ড করছে আরও বেশি। আরোও দু প্যাগ পেটে পড়তেই কথা নয় এবার গৌরির মুখ তার চোখের সামনে। আর পারলনা। উঠে চলে গেলো পাশের রুমে। গৌরি মেঝেতে বসে ল্যাপটেপ একটা হিন্দী মুভি দেখছে। ঈপ্সিতা তৈরী হচ্ছিল রাকায়াত এর রুমের দিকে যাবে বলেই। রাকায়াত টলতে টলতে এসে তার হাতটা ধরল। কানের কাছে কান নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল , ‘ডার্লিং , ও ঘরে যাও, আমি একটু গৌরির ফিজিক্যাল টেস্ট নেবো।’

প্রথমে ঈপ্সিতা মানা করলো। তারপর রাকায়াতের রক্তচক্ষু তাকে থামিয়ে দিল। এত কিছুর বিনিময়ে, এত দেহের কদর্য গায়ে জড়িয়ে সে সুখ যে নাম সে কামিয়েছে , তার একটা গ্রাম্য মেয়ের জন্য বিসর্জন দেয়ার মত স্বার্থহীণ সে হতে পারবে কেনো? হনহন করে হেঁটে সে পাশের কম্পার্টমেন্টে গেলো।

দরজাটা ভেড়ানোর শব্দে চোখ তুলে তাকাল গৌরি। দেখল রাকায়াত সাহেব টলছে। তার দিকে ভবয়াবহ বাজে একটা হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে লোকটা। কিছুটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। হাতটা ধরে বিছানার উপর বসিয়ে দিল। সল্প পরিসর। নড়াচড়া করাও কঠিন।
‘স্যার, কি করতাছেন?’

‘কিছুনা। তোমার একটু টেস্ট হবে। কতটা দূর তুমি এগিয়ে যাবে এ তার টেএস্ট...’

‘ কিছুই তো বুঝবার পারতাছিনা স্যার, আপনি তো টলটাতাছেন, ম্যাডাম কই?’
‘কেউ আসবেনা, কেউ না...এ ..এ..একট্ওু কষ্ট হবেনা লক্ষ্মীটি , আমি তোমাকে খুব যতেœ আদর করব। তোমার কোমল নরম তনু... কামিজটা খুলে ফেলেতো সোনা...।’

‘স্যার...আপনি আমার বাপের লাহান, আপনে এইসব কি কন...’

‘দূর তোর বাপের মত, খোল না, তোকে কত বড় নায়িকা বানিয়ে দেবো তুই কল্পনাও করতে পারবিনা..’

বলতে বলতে রাকায়াত গৌরিকে দুই হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। তার মুখে ঠোঁটে মুখ ঘঁষতে শুরু করে। এক ঝটকায় গৌরি তাকে সরিয়ে দেয়। মুখর উপর ছিটিয়ে দেয় এক দোলা থু থু। তারপর দরজার দিকে ছুটে যায়। সেটা লক করা ছিলনা। এক ধাক্কায় খুলে যেতেই ছূটে নেমে যায় লরি থেকে। তারপর দৌড়াতে থাকে রাস্তা বরাবর।

খুব কাছেই একটা গাছ তলে টিনের ছাউনীর নিচে জগলু দলবল নিয়ে তাস পেটাচ্ছিল। দৌড়ের দৃশ্যটি তাদের চোখ এড়ালোনা। চোখ এড়ালোনা লরি থেকে একটু পড়েই নেম আসা রাকায়াত সাহেবের অবয়বটি। তারা ছুটে গেলো।
‘স্যার কি হইছে। মাইয়্যাডা পালাইলো নাকি। আগেই কইতে চাইছিলাম ঐডা একটা ...’

‘জগলু কথা কম, মেয়েটাকে তুমি যে পছন্দ কর সেটা আমি জানি। খুব ভাল করেই জানি। যাও যে করেই পার ধরে নিয়ে আস। আমি তোমাকে অনেক টাকা দেবো, নগদ দেবো, নগদ, যাও। ’
টলতে টলতে পড়েই যাচ্ছিল রাকায়াত। তাকে মন্তেÍজ ধরে ফেলল। রাকায়াতের তবুও মুখ চলছে, ‘জগলু, চাইলে তুমি একটু চেখে আমার কাছে পাঠিও, মাঝে মাঝে রেপড হ্ওয়া মেয়েও র্যইপড করতে মন চায়, ভেরিয়েশন হা হা হা ...সংখ্যালঘু মেয়ে, হা হা হা।’

আর দেরী করেনা জগলু। সাথের পাঁচজনকে নিয়ে সে ছুট দেয়। বাতাসের বেগ বেড়েছে। দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও মেয়েটাকে তো ধরতেই হবে। কতদিনের খায়েস, সে চোখে স্বর্গ জ্যেতি দেখছে। ঐ তো মেয়েটা পাকা রাস্তায় উঠে গেছে প্রায়। ব্রীজের আগেই একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। গাছের গোড়াতে পৌঁছানোর আগেই গৌরিকে ধরে ফেলল জগলু। এক টানে ওড়নাটা ছিনিয়ে নিয়ে প্যাঁচালো হাতে।

অন্যদের বলল, ‘পাহারা দে। আমি ওরে ঝোঁপটার ওপাশে নিয়া একটু চাইখা লই। রাকয়াত সাহেবতো কইলোই। লোকটা একটা বস পাবলিক।’

সাত.
বাতাসের জন্যে দ্রুত আগানো যাচ্ছেনা। যতদূর সম্ভব দ্রুত প্যাডেল চালাচ্ছে গঙ্গল। মনটা কেন যেন উতলা হচ্ছে বারবার। এরমধ্যেও মনে হলো-‘সকালেই আসলে হত। এই ঝড়ের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে আসবে কি করে।’

নদীর কাছে চলে এসছে সে। তারপরই বাতাসের শো শো শব্দের মাঝেও কানে যেন একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। গৌরির কণ্ঠই তো। গতি বাড়াল প্যাডেলের। ব্রীজটার উপর উঠতেই চোখে পড়ল কয়েকটা ছাযামুর্তি। ধস্তাধস্তিও চলছে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কাউকে ওপাশের ঝোঁপের দিকে। ভ্যান নামল গঙ্গল। ভ্যানের নিচে একটা ধান কাটা কাঁচি সে সবসময় বেঁধে রাখে। এক টানে সেটা ছুটিয়ে নিল। আবার কানে এল চিৎকার কিন্তু অসম্পূর্ণ। বিদ্যুৎ চমকালো, স্পষ্ট দেখল দূরে একটা মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে একটা লোক। মেযেটার কাপড় এক ঝলকেই চিনিয়ে দিল বাবার চোখকে। হাতের কাচিটা উঁচিয়ে এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে মেয়েকে ছিনিয়ে নিল জগলুর হাত থেকে। যৌনাবেগে মোহিত জগলু হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারলনা। মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে নদীর কিনারে পৌঁছে গেলো গঙ্গল। পেছনে জগলু আর সাথে আরও পাঁচজন। ঘিরে ধরল একরকম। একপাশে নদী আর তিনদিকে আততায়ী। মন্তেজর হাতে একটা পিস্তল। সবাই এগিয়ে আসছে বাবা-মেয়ের দিকে। হঠাৎ আবার বিদ্যুৎ চমকালো। দুটো ছেলের হাতে চকচকে ছুরি ঝিলিক দিয়ে উঠল। পরিবশেট এখন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গৌরি বাবার হাতে আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে অঝোরে। এগিয়ে আসছে দলটা কেড়ে নিতে তার যক্ষের ধন, লক্ষ্মী মা মণি গৌরিকে। শকুনের দলের ভীষণ ক্ষুধার্ত চাউনি গঙ্গল বুঝতে পারেছেনা কি করবে। নদীতে ছাপ দেয়ার উপায় নেই। এদিকটা কাটা ঝোঁপে ভরা।
ধরে ফেলবে আরেকটু এগোলেও । পেছনে আর পেছনোর পথ নেই। মেয়েটা এখন অঝোরে কাঁদছে। বলছে , ‘বাবা আমারে বাঁচাও, বাঁচাও বাবা।’

কি করবে কিছুই বুছতে পারছেনা। ছিনিয়ে নিয়ে মেয়েকে শয়তানগুলো কি করবে ভাবতেই রক্ত তার হীম হয়ে আসছে। সে একা কি করে পারবে। আর এক হাত দূরে মাত্র। ঘিরে ধরেছে ছয়টি পশু। হঠাৎ এক হাতে মেয়ের চোখটা চেপে ধরে অন্য হাতে ধরা ধারালো কাচিটা বসিয়ে সজোরে টান দিল মেয়ের নরম গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে ভিজিয়ে দিল তাকে। এ ঝলক আলো আকাশে ঝলছে উঠল। টকটকে লাল রক্ত সব ক’টা পশুকে মুহূর্তে থামিয়ে দিল। কোন কিছুর পরোয়া করলনা গঙ্গল , সে একজন বাবাই তো শুধু নয় সে তো মা ও একাধারে। এই ঢের ভালো হলো, মেয়েটা বেঁচে গেলো। মেয়ের দেহটা নিথর পড়ে যাচ্ছে ঘাসের উপর। বিস্মিত চোখের দর্পণে সে এক অবর্ণীয় ছায়া তখন গঙ্গলের । মেয়েটার দেহটা ঘাসের উপর নামিয়ে রক্ত মাখা কাচিটা সজোরে চালালো সামনে যে পশুটাকে নাগালে পেলো। লাগলোনা কারও গায়।
একটা গুলি ছুটে এল পরক্ষণেই, ডান হাতের উপরে কাঁধের কাছে লাগতেই গঙ্গল ঢলে পড়ল মেয়ের মৃত দেহেটার উপর।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুন ম. আজিজ ৩২টি জেনুইন কমেন্ট...সবাই কমপক্ষে ৩ করে ভোট দিলেও ৯৬ হবার কথা..তাতে বোঝা.. যায় ভোট কৃপনা খুব বেশি পাঠকের মধ্যে..অথচ আমি ৩ এর নিচে ভোট প্রায় দেইনা..তাতে বুঝলাম আমি ভোট দেয়া বিষয়টায় পরিণত নই....১/২ ভোট দেয়াটাও একটা শেখার বিষয়।
এরকম একটা কষ্ট আমার ও আছে সেই জন্যই বাবা সংখ্যাতে ভোট বন্ধ রেখেছিলাম ........
পারভেজ রূপক দুর্দান্ত কাহিনী
সেলিনা ইসলাম সমাজের কিছু অসৎ ও মুখোশধারি অমানুষের কাছ থেকে মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিজের সন্তানকেই মেরে ফেলা এ এক অসীম ও কষ্টকর দৃষ্টান্ত ! ধিক এই সমাজের মুখোশধারিদেরকে ,যারা সমাজের উপকারের নামে সমাজকে ঠেল দিচ্ছে অন্ধকারে । গল্পের প্রতিটা চরিত্র বেশ জীবন্ত করে লেখক ফুটিয়ে তুলেছে বিশেষ করে অশিক্ষিত অথচ বুদ্ধিমতি বৌদির স্পষ্টভাষী আচরণ । সাধুবাদ জানাই লেখককে এতো কঠিন একটা চিত্রকে সাবলীলভাবে উপাস্থাপনের জন্য । অভিনন্দন ...!
Mohammad Alvi ভালো লাগলো
রোদের ছায়া বাহ বাহ এত বড় গল্প দুই দিনে পড়লাম .... কয়েক জায়গায় ছোটখাট বানানে সমস্যা চোখে পড়ল , এছাড়া অনেক ভালো একটা গল্প ...ফিনিশিং তা যদিও আমার ভালো লাগলো না কিন্তু অন্য রকম তো বটেই ..বাবার হাতেই শেষ পর্যন্ত মেয়ে খুন হলো এটা কি মেনে নেয়া যায় ? আর গল্পের শুরুতে গ্রাম আর প্রকৃতির বর্ণনাটি একটু কম হলেই ক্ষতি ছিল না । আপনার জন্য শুভকামনা থাকলো মামুন ভাই ।
গল্প কবিতা আামার গল্প প্রাকটিসের জাযগা..তাই আমি গবেষনা করি।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম ।
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ পরিপক্ক, পরিপূর্ণ এবং পরিচ্ছন্ন লেখা। নিসর্গ ও অনুষঙ্গ এসেছে আপন মহিমায়।জোড়ালো সংলাপ আর গতিময়তা গল্পটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। ভাললাগা আর ভালবাসা রইলো।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪